৩২টি উন্নয়ন প্রকল্প সম্পন্ন করেছে মেঘনা পেট্রোলিয়াম: আরো ২৩টি বাস্তবায়নের পথে


২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সরকারের মালিকানাধীন মেঘনা পেট্রোলিয়াম কোম্পানি লিমিটেড ৩২টি উন্নয়ন এবং ব্যবসা সম্প্রসারণ বিষয়ক প্রকল্প সম্পন্ন করেছে। আগামী অর্থাৎ চলতি হিসাব বছরে আরো ২৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলে শেয়ারবাজারনিউজ ডটকমকে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানেআবু হেনা মো: রহমাতুল মুনীম।
তিনি জানান, আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে কোম্পানিটির ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরের ৩৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে আমাদের এসব উন্নয়নমূলক প্রকল্পের অগ্রগতি এবং ব্যবসায়িক সাফল্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরা হবে।
জানা যায়, গত এক বছরে কোম্পানিটি যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: চট্টগ্রামে রেল ওয়াগন ফিলিং শেড নির্মাণ, রেল ওয়াগন ফিলিং পয়েন্ট সম্প্রসারণ, ট্যাংক ৪৬৮ থেকে ট্যাংক ৪৭০ পর্যন্ত ১৮ ফুট প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ, রুফ হয়েস্ট মেশিন(ক্রেইন) সরবরাহ ও স্থাপন, ৭০ কেভিএআর পিএফআই প্যানেল ও এলটি ক্যাবল সরবরাহ ও স্থাপন, এলজে-৪ থেকে ডিওজে-৫ পর্যন্ত এইচওবিসি রিসিভিং পাইপ লাইন নির্মাণ, লুব এর ওপেন সেড এবং এলপিজি গোডাউন নির্মাণ, নারায়ণগঞ্জে কোম্পানির নিজস্ব প্লটে ভূমি উন্নয়ন কাজ, ফায়র পাম্প হাউজ ওয়াটার রিজার্ভার এবং হাউড্রেন্ট সিস্টেম নির্মাণ, ফার্ণেস অয়েল ফিলিং গ্যান্টি ও ড্রাইভ ওয়ে নির্মাণ এবং কুড়িগ্রামে সোলার প্যানেল স্থাপন।
এদিকে কোম্পানিটির ২৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: কোম্পানিতে অটোমেশন সিস্টেম স্থাপন, চট্টগ্রামে ১৯তলা বিশিষ্ট মেঘনা ভবন নির্মাণ(এতে প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয় হবে), এলজে-৪ পল্টুন জেটি মেরামত, অয়েল সেপারেটরসহ বাল্ড ওয়াল ও সারফেস ড্রেন নির্মাণ, পাম্প হাউজের জন্য ওভারলোড ক্রেইন ক্রয় এবং প্রতিস্থাপন, ফায়ার হাইড্রেন্ট লাইন আধুনিক এবং যুগোপযোগী করণে, নারায়ণগঞ্জে পাম্প হাউজ নির্মাণ, খুলনায় ফায়ার পাম্প হাউজ নির্মাণ এবং নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় ৩তলা বিশিষ্ট অফিস ভবন নির্মাণ।
এছাড়া ঢাকার মতিঝিলে কোম্পানির নিজস্ব ২২.৫০ কাঠা জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। এখানে ৪০তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে কোম্পানিটির। ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কোম্পানি ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি লুব ব্লেন্ডিং প্ল্যান্ট স্থাপন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
এসব কাজে প্রায় কয়েক শত কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে জানিয়েছেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান।
এদিকে কোম্পানিটির ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, আলোচিত সময়ে কোম্পানিটি ১৪ হাজার ২০২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা মূল্যের ১৭ লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য ও লুব্রিক্যান্টস বিক্রি করেছে। এর আগের বছর কোম্পানিটি ১৪ হাজার ৩৯৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা মূল্যের ১৮ লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন পণ্য বিক্রি করেছিল। দেখা যাচ্ছে এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির পণ্য বিক্রি ০.৭৭ শতাংশ কমেছে। এতে কোম্পানিটির আয় ১.৩৫ শতাংশ কমেছে। এছাড়া ৩০ জুন, ২০১৬ সমাপ্ত সময়ে কোম্পানিটি ৮ হাজার ৬১১ মেট্রিক টন লুব্রিক্যান্টস বিক্রি করেছে। যা এর আগের বছর একই সময়ে ছিল ৮ হাজার ৬৪৬ মেট্রিক টন লুব্রিক্যান্টস বিক্রি করেছিল। তবে আলোচিত সময়ে কোম্পানিটির ডিজেল বিক্রি ১ লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন বেড়েছে। কিন্তু বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানির নিজস্ব ব্যবহারের জন্য সরাসরি আমদানির সুযোগ পাওয়ায় মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ফারেন্স অয়েল বিক্রি ৯৭ হাজার মেট্রিক টন কমেছে।
উল্লেখ্য, ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে দেশে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের ব্যবহার হয়েছে ৫২ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন। যা এর আগের অর্থ বছরে ছিল ৫৩ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন।
তেল বিপননকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের বাজার অংশীদার জ্বালানি তেল, এলপিজি ও বিটুমিনে ৩৭.১৯ শতাংশ এবং লুব্রিক্যান্টসে ৪৯.৭২ শতাংশ। অর্থাৎ তেল বিপননকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে বাজার অংশীদারিত্বে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের অবস্থান শীর্ষে রয়েছে।
তবে আলোচিত সময়ে কোম্পানিটির পরিচালন ব্যয় ১৪ কোটি টাকা বেড়েছে। ৩০ জুন, ২০১৬ সমাপ্ত হিসাব বছরে কোম্পানিটির মোট পরিচালন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৯৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। যা এর আগের বছর ছিল ৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এ বিষয়ে কোম্পানিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সংশোধিত নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন এবং গ্র্যাচুইটি খাতে প্রভিশন বৃদ্ধির কারণে কোম্পানির পরিচালন ব্যয় বেড়েছে।
আলোচিত সময়ে কোম্পানিটির কর পরিশোধের পর প্রকৃত মুনাফা হয়েছে ১৮৫ কোটি টাকা এবং ইপিএস ১৭.১০ টাকা। যা এর আগের বছর ছিল ২০৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং ইপিএস ১৮.৮০ টাকা। আলোচিত বছরে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের ১০৫ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। এতে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা থেকে ডিভিডেন্ড হিসেবে ১১৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা বন্টন করবে। বাকী ৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা পরবর্তী হিসাব বছরে স্থানান্তর করা হবে।
আলোচিত বছরে কোম্পানির মূলধন প্রয়োগের উপর আয়ের হার ২৯.৫৫ শতাংশ। যা এর আগের বছরে ছিল ৩৪.৬১ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় মূলধন প্রয়োগের উপর আয়ের হার ১৪.৬২ শতাংশ কমেছে।
এ বিষয়ে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মো: রহমাতুল মুনীম শেয়ারবাজারনিউজ ডটকমকে বলেন, ‘বিক্রয়, বিতরণ ও প্রশাসনিক খরচ এবং গ্র্যাচুইটি সঞ্চিতি বেড়েছে। আর এ কারণে মুনাফা কমেছে। তাছাড়া গ্যাস ফিল্ড সমূহে উৎপাদিত পণ্য তেল বিপননকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের পরিবর্তে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) কর্তৃক সরাসরি ক্রয় করার কারণেও কোম্পানির পণ্যের মার্জিন কমেছে।
এদিকে, ২০১৫-২০১৬ হিসাব বছরের নিরীক্ষক সাইফুল শামসুল আলম এবং হুদা ভাসী চৌধুরী এন্ড কো এর মতামতে বলেছে, এমপি এমসিএল এবং পিপিএল থেকে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তির আইনগত স্বত্ব এখন পর্যন্ত মেঘনা পেট্রোলিয়ামের নামে স্থানান্তর করা হয়নি যা পরবর্তীতে আইনগত জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি গত ২০০৩ সাল থেকে বিপিসি এর অন্যান্য অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের কাছে বাকীতে তেল বিনিময়ের কারণে বর্তমান মূল্যে কোম্পানিটি ৩ কোটি ৮ লাখ ২৩ হাজার টাকা তাদের কাছে পাবে দেখানো হয়েছে। এরমধ্যে ২ কোটি ৩৫ লাখ ৯৯ হাজার টাকা অনাদায়অ হিসেবে সঞ্চিতি রাখা হয়েছে। যদিও তা আদায় করার সম্ভাবনা খুবই কম।
এ প্রসঙ্গে কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের স্থায়ী সম্পত্তিগুলো মূলত এ্যাসো(ESSO) এবং দাউদ পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের নামে রেজিস্ট্রিকৃত। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩১ মার্চ, ১৯৭৮ সাল থেকে এই সমস্ত কোম্পানির সকল স্থায়ী ও অস্থায়ী সম্পত্তি মেঘনা পেট্রোলিয়ামের উপর অর্পিত হয়। সারাদেশে বিস্তৃত মেঘনা পেট্রোলিয়ামের এই সম্পত্তিগুলির রেজিস্ট্রি ও নামজারি ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। তবে কোম্পানিটি এ নিয়ে কাজ করছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু সম্পত্তির নামজারী সম্পন্ন হয়েছে।
অনাদায়ী টাকা আদায়ের বিষয়ে কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ আরো জানায়, বিপিসি’র বিভিন্ন ইউনিটগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে তেল বিনিময়ের একটি প্রথা ২০০৩ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ উক্ত পণ্য মূল্যের অর্থাৎ ৩ কোটি ৮ লাখ ২৩ হাজার টাকার সম্ভাব্য পাওনার বিপরীতে ২ কোটি ৩৫ লাখ ৯৯ হাজার টাকা হিসাবভুক্ত করেছে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বিপিসি’র মধ্যস্থতায় আন্ত:কোম্পানিগুলির মধ্যে অসমন্বিত হিসাবগুলোর মধ্যে মিলামিল করণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিপিসি এবং তেল বিপনন কোম্পানিগুলোর মধ্যে হিসাবের মিলামিলকরণের জন্য বিপিসি কর্তৃক কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়ার ফলে ২০১৪ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র বিপিসি’র সাথে কোম্পানিগুলোর দেনা পাওনার মিলামিলকরণ সম্পন্ন হয়েছে। সম্প্রতি বিপিসি কর্তৃক পুনরায় বিপিসি এবং আন্ত:কোম্পানি হিসাবের মিলামিলকরণের জন্য নিরীক্ষা ফার্ম নিয়োগ দিয়েছে। সুতরাং বিপিসি এবং আন্ত:কোম্পানির দেনা-পাওনায় মিলামিলকরণ ও নিষ্পত্তি সহসাই সম্পন্ন হবে আশা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ১০৮ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানির ৫৮.৬৭ শতাংশ শেয়ার সরকারের কাছে, ৩০.৭০ শতাংশ শেয়ার প্রতিষ্ঠানের কাছে এবং ১০.৬৩ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে রয়েছে। চলতি ২০১৬-২০১৭ হিসাব বছরের অর্ধবার্ষিকে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ১০.১২ টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কোম্পানিটির শেয়ার দর ১৭২ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০৩ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার দর ২০০ টাকা।


Comments