বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি চীন।
আফ্রিকায় দেশটির বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে আগে থেকেই। বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে
মিয়ানমারেও। শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ অবসানের পর সে দেশের বন্দরসহ ভৌত অবকাঠামো
নির্মাণে বড় বিনিয়োগ করেছে দেশটি। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের জন্য
বেইজিংয়ের রয়েছে ৪৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পরিকল্পনা।
এবার বাংলাদেশে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের
ঘোষণা দিল চীন। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরকালে দুই দেশের
মধ্যে শুক্রবার এ-সংক্রান্ত ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা এটিকে দেখছেন চীনের অর্থনৈতিক কূটনীতির শক্তি হিসেবে।
এর আগে গত বছরের ৬ জুন বাংলাদেশ সফরে আসেন
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তার সফরকালে ২
বিলিয়ন ডলার সহযোগিতার ঘোষণা দেন। ২০১৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সফরে
আসেন বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ অর্থনীতি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। একই
বছরের মে মাসে টোকিও সফরে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর ওই
সফরকালে জাপানের কাছ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পায় বাংলাদেশ।
দুদিনের সফরে গতকাল বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে
ঢাকায় পৌঁছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সফরের প্রথম দিনে গতকাল বিকালে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় নানা
বিষয় নিয়ে কথা বলেন দুই নেতা। বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে সই হয় ২৭টি চুক্তি
ও সমঝোতা স্মারক। শি জিনপিং ও শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এসব চুক্তি ও সমঝোতা
স্মারকে সই করেন দুই দেশের প্রতিনিধিরা।
এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সম্পর্কে
পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন,
চীনা প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে
সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। শি জিনপিংয়ের এ
সফরের মধ্য দিয়ে চীন ও বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক কৌশলগত সম্পর্কে
উন্নীত হয়েছে।
পররাষ্ট্র সচিব জানান, শেখ হাসিনা ও শি
জিনপিংয়ের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দুই দেশের সরকারের মধ্যে ১৫টি চুক্তি
ও সমঝোতা স্মারক এবং ১২টি ঋণ ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়েছে।
স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের মধ্যে
রয়েছে দুর্যোগ মোকাবেলা ও হ্রাসকরণ, বিনিয়োগ ও উৎপাদন-সক্ষমতা সহযোগিতা,
বাংলাদেশ-চীন মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাই, সামুদ্রিক সহযোগিতা,
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সহযোগিতা,
ইনফরমেশন সিল্ক রোড, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সহযোগিতা এবং সন্ত্রাসবাদ
মোকাবেলা সহযোগিতা। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর নিচে একাধিক লেনের টানেল নির্মাণ ও
দাশেরকান্দিতে সাগরকেন্দ্রিক ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বাস্তবায়নের জন্য চারটি
পৃথক ঋণচুক্তি সই হয়েছে।
গতকাল বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে এয়ার চায়নার
একটি বিশেষ ফ্লাইটে কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন থেকে ঢাকায় পৌঁছেন শি জিনপিং।
তাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি বাংলাদেশের আকাশসীমায় পৌঁছলে সেটিকে পাহারা দিয়ে
নিয়ে আসে বিমানবাহিনীর চারটি জেট বিমান। বিমানবন্দরে চীনা প্রেসিডেন্টকে
অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রীয় এ অতিথিকে ২১ বার
তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। লাল গালিচা সংবর্ধনার সঙ্গে সামরিক
বাহিনীর সুসজ্জিত একটি দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এ সময় দুই দেশের
জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে মোটর
শোভাযাত্রাসহকারে চীনের প্রেসিডেন্টকে নেয়া হয় লা মেরিডিয়ান হোটেলে।
বেলা ৩টায় চীনের প্রেসিডেন্ট তার
সফরসঙ্গীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছেন। সেখানে তাকে স্বাগত
জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন তারা।
দুই দেশের প্রতিনিধি দলও বৈঠকে অংশ নেয়। বৈঠক শেষে ছয়টি প্রকল্পও উদ্বোধন
করা হয়।
গতকাল উদ্বোধন করা প্রকল্পগুলো হলো— ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইনস্টিটিউট স্থাপন, কর্ণফুলী নদীর নিচে একাধিক লেনের
টানেল নির্মাণ, পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ
প্রকল্প, চার স্তরের জাতীয় তথ্যভাণ্ডার, চট্টগ্রামে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের
তাপবিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ এবং শাহজালাল সার কারখানা নির্মাণ প্রকল্প।
সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক
অনুষ্ঠিত হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক সাংবাদিকদের জানান,
চীনের প্রেসিডেন্টের এ সফর ঐতিহাসিক। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে
বহুমাত্রিকতা আরো বিস্তৃত ও গভীর হবে, ব্যাপ্তি বাড়বে। বাংলাদেশ ও চীনের
মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক এখন কৌশলগত সম্পর্কে উন্নীত হয়েছে।
দুই দেশের মধ্যে আমরা সম্পর্কের নতুন অবয়ব দেখব।
বৈঠকে উঠে আসা বিষয়গুলোর রাজনৈতিক দিক
রয়েছে মন্তব্য করে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আগামীতে বিভিন্ন পর্যায়ে দুই দেশের
সফর দেখা যাবে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তিতে নতুন ফ্রেমওয়ার্কের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং একটি সমঝোতা
স্মারকও সই হয়েছে।
চীন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও পাট শিল্পে
বিনিয়োগের ইঙ্গিত দিয়েছে জানিয়ে শহিদুল হক বলেন, উৎপাদনে সক্ষমতা বাড়ানোর
বিষয়ে এ-সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক হয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে
একসঙ্গে কাজ করতে দুই নেতা একমত হয়েছেন বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব।
গত ৩০ বছরের মধ্যে কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের
এটিই প্রথম বাংলাদেশ সফর। এর আগে ১৯৮৬ সালে ঢাকা সফরে এসেছিলেন তত্কালীন
চীনা প্রেসিডেন্ট লি শিয়ানইয়ান। ‘ওয়ান-বেল্ট, ওয়ান রোড’ নীতি ধরে এগিয়ে
যাওয়া চীনের সহযোগিতা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ঢাকা সফর করছেন শি জিনপিং।
ঢাকায় পৌঁছার পর পরই বাংলাদেশকে দক্ষিণ
এশিয়ায় চীনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বলে মন্তব্য করেন শি জিনপিং। এক
বিবৃতিতে তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশকে
গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে চীন। পারস্পরিক রাজনৈতিক আস্থা আরো গভীর করতে
বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত আমরা। দুই দেশের সহযোগিতামূলক
সম্পর্ককে আমরা আরো উঁচুতে নিয়ে যেতে চাই।
বিমানবন্দরে অবতরণের পর দেয়া ওই বিবৃতিতে
শি জিনপিং বলেন, ৪১ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাসে চীন-বাংলাদেশ
বন্ধুত্ব সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চীন ও বাংলাদেশকে একই ধরনের উন্নয়নকাজ
সম্পাদন করতে হচ্ছে জানিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, চীনের স্বপ্ন হচ্ছে,
বাংলাদেশের স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’র সঙ্গে নিবিড় সংহতির মাধ্যমে পুরো চীনকে
তেজোদীপ্ত করা।
চীনের প্রেসিডেন্ট তার সফরসূচির অংশ হিসেবে
আজ সকালে হোটেল লা মেরিডিয়ান থেকে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাবেন। সেখানে
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর সরাসরি যাবেন হযরত শাহজালাল
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখান থেকে ভারতের গোয়ার উদ্দেশে রওনা হবেন শি
জিনপিং। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানাবেন।
পেছনের খবর : ২৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত
Comments
Post a Comment