মহাসঙ্কটে আবাসন খাত: ঝুঁকিতে ৯০ হাজার কোটি টাকা ৫ কোটি মানুষের জীবিকা

মহাসঙ্কটে পড়েছে সম্ভাবনাময় আবাসন খাত। বিদেশি সাহায্যপুষ্ট কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) পরিকল্পিতভাবে এ খাত ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে মনে করছেন এ খাতেরই বিনিয়োগকারীরা।

তাদের অভিযোগ, নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে এসব এনজিও আইনি জটিলতায় ফেলছে আবাসন খাতকে। ভুল তথ্য দিয়ে এরই মধ্যে তারা আবাসন প্রকল্পগুলোর উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে দেওয়ার পাঁয়তারা চালিয়েছে। তাদের এই চক্রান্তে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। একইস সঙ্গে আবাসিক ও ভূমি উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হলে কমপক্ষে তিন কোটি মানুষ সম্পূর্ণ বেকার ও প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে আবাসন খাত ধ্বংসের মাধ্যমে ব্যবসায়ী ও জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে।

এদিকে আবাসন খাতের চরম এই দৈন্যদশার কথা স্বীকার করেছেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন (রিহ্যাব) সভাপতি নসরুল হামিদ বিপু এমপি।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আবাসন খাতে সংকট এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগের অভাবে পাঁচ হাজার রেডি ফ্যাট ডেলিভারি দেওয়া যাচ্ছে না। এতে ফ্যাট ও জমির মালিক এবং ডেভেলপাররা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। উপরন্তু, শুধু ফ্যাটেই ঝুঁকিতে পড়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা।’

তিনি বলেন, ‘সরকার এই মুহূর্তে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আবাসন খাত ধ্বংসের মুখে পড়বে।’

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের হিসেব অনুযায়ী, আবাসন শিল্পে রয়েছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। এর এক-তৃতীয়াংশই প্রবাসী বিনিয়োগ। মধ্য আয়ের মানুষের সঞ্চয় ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ ঋণের টাকাও গচ্ছিত আছে এ খাতে। এ খাতকে ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৭০টি উপখাত। এগুলোতে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ১০ হাজার শিল্প। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পে কাজ করছে লাখ লাখ মানুষ।

রাজউকের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত আবাসন উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় দুই শতাধিক উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছে। এর মধ্যে রাজউক ২৬টি প্রকল্প অনুমোদন দিলেও বাকি ১৭৪টি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পগুলোতে এরই মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে।

রিহ্যাবের হিসেব মতে, আবাসন শিল্প জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে শতকরা ২১ ভাগ। এ খাতে বিনিয়োগ করা টাকার ৩০ শতাংশ এসেছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ থেকে। যার পরিমাণ ২১ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

আবাসন খাতে বর্তমানে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন ৫০ লাখ শ্রমিক। যার সঙ্গে জড়িত প্রায় আড়াই কোটি মানুষের ভরন পোষণের প্রশ্ন। এছাড়াও হাউজিং এবং ভূমি উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত রয়েছে আরো শতাধিক শিল্প উপখাত। এসব খাতের বিনিয়োগের পরিমাণও কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ সকল শিল্প উপখাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে আরো দেড় কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এসবের জন্য যেসব বেসরকারি সংস্থাকে দায়ী করা হচ্ছে তারা ঢাকা ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করলেও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা সফল হয়নি বলে মনে করেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্যের মন্ত্রিসভা কমিটি ড্যাপ নিয়ে কাজ করছে। তাদের সুপারিশ চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত ড্যাপ কার্যকর হচ্ছে না বলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।

এ অবস্থায় ওইসব বেসরকারি সংস্থা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে জড়িত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিরোধিতায় নেমেছে। এ চক্রান্ত সফল হলে দেশের আবাসন উন্নয়ন এবং ভূমি উন্নয়ন খাতে ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে।

ড্যাপ পর্যালোচনার জন্য সরকারের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি ১৬টি আবাসন প্রকল্প ও স্থাপনা এবং দুই হাজার ৭২৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ড্যাপের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ (নন-কনফার্মিং) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কমিটি প্রকল্পগুলো অনুমোদন না দিতে এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছে। এরমধ্যে আবাসন প্রকল্প রয়েছে মোট ১৬টি। যার ছয়টিই সরকারি প্রতিষ্ঠান।

এ নিয়ে সরকারের কাছে ড্যাপ নিয়ে চারপাতার একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। যাতে বলা হয়েছে-ড্যাপ বাস্তবায়িত হলে সরকার রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক তিগ্রস্ত হবে। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়- কয়েকটি এনজিও তাদের প্রচারণায় সেনাবাহিনীকে ক্ষেপিয়ে তুলতে আর্মি হাউজিং প্রকল্প বন্ধ ও আবাসন খাতে অরাজকতা তৈরির চেষ্টা করছে। সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ ও ব্যবসায়ীদের খেপিয়ে তোলারও চেষ্টা করছে তারা।

অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যাও আবাসন ব্যবসায়ীদের জন্য কাল হয়ে দেখা দিয়েছে। গত এক বছর ধরে এ খাতে নতুন করে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়ায় এ সঙ্কট আরো ঘণীভূত হয়েছে। এর ফলে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের শতশত কোটি টাকা আটকে গেছে বলে জানিয়েছে রিহ্যাব সূত্র।

রিহ্যাব সূত্র আরো জানায়, এ সঙ্কটের জন্য বর্তমানে ঢাকায় তিন শতাধিক নতুন প্রকল্পে ৩৬শ’ এপার্টমেন্ট ভবন নিমার্ণের কাজ আটকে আছে। এতে এ খাতে জড়িত প্রায় দুই লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ও ৩০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।

এছাড়াও এ কারণে চার হাজার ক্রেতা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ১২শ’ কোটি টাকা লোন নিয়ে কিস্তি পরিশোধ করার পরও প্রতি মাসে ১০ কোটি টাকারও বেশি বাসা ভাড়া ও ১৫ কোটি টাকা ব্যাংক সুদ দিতে বাধ্য হচ্ছে।

Comments